"আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই..." গানটা আমি শুনিনি কখনো কিন্তু যে শহরে থাকি সেখানকার জন্যে এই লাইনটা একদম পারফেক্ট। আল্পস এর পাদদেশে এই ট্রেনটো শহরে আগে নাকি লোকজন স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য আসতো, আর এখন আসে স্কি করতে। স্কি ট্র্যাক হিসাবেও ট্রেনটো বেশ বিখ্যাত। আমাদের আমেরিকান বন্ধু জেফ, যে নাকি কলোরাডোতে হাঁটতে শেখার আগে স্কি করতে শিখেছে, এখানকার ট্র্যাকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। জেফ বলেছিলো ওর সাথে স্কি করতে গেলে শিখিয়ে দেবে, কিন্তু আমার হাত-পা ভাঙ্গার ভীতিজনিত কারণে আর যাওয়া হয়নি। এই শীতের সিজন শুরু হওয়ার পর থেকেই দেখছি রাস্তাঘাটে অনেক লোকজন (ইউনির প্রফেসর পর্যন্ত) পায়ে ব্যান্ডেজ, হাতে ক্রাচ আর মুখে পরিতৃপ্তির হাসি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এইটাই শীতের স্টাইল, স্কি করতে গিয়ে পা ভাঙ্গা নিয়ে কথা!
অন্য ইউনির কথা জানিনা কিন্তু আমাদের এখানকার ওয়েলকাম অফিস (মানে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অফিস) খুবই অ্যাক্টিভা এবং হেল্পফুল। ইতালির মত দেশে, যেখানে ব্যুরোক্রেসির লাল ফিতার দৌরাত্ন্য বাংলাদেশের চেয়ে কম না, এই ওয়েলকাম অফিসের জন্যেই আমাদের ভিসা, হোস্টেল, স্টে পারমিট, ডাক্তার দেখানো থেকে শুরু করে অন্য দেশে ঘুরতে গিয়ে পাসপোর্ট হারানো - সব মুশকিলের আসান হয়ে যায় নিমিষেই। এসব ঝামেলা মেটানোর পরেও ওরা আরো অনেক কিছু করে, যেমন মুভি শো, ওয়েলকাম পার্টি, ল্যাংগুয়েজ ক্যাফে। তবে সবার সবচাইতে প্রিয় মনে হয় ওদের ট্যুরগুলো, প্রতি মাস-দুমাসে আয়োজন করে ওরা, আশেপাশের শহর, লেক, পাহাড় বা মিউজিয়ামে। এসব ট্যুর লিমিটেড লোকের জন্যে হয়, খুব তাড়াতাড়ি মেইল করে কনফার্ম না করলে মিস হয়ে যায়। তবে বাঙ্গালিরা একজন জানা মাত্রই সবাইকে জানানো হয়ে যায় বড়জোর একঘন্টায়, তাই ওয়েলকামের সব ট্যুরেই অর্ধেক বাস ভর্তি থাকি আমরা!
Dolomiti বা ডলোমাইটস ট্যুরের জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করে যাওয়া হলো এই গত শনিবারে। বাস জার্নিটা খুবই দারুণ ছিলো, পাহাড়ি রাস্তায় এমন সব কার্ভ, মনে হচ্ছিলো থিমপার্কের কোন রাইডে চড়েছি। ডলোমাইটস এর কাছাকাছি যেতেই দেখা গেলো দলে দলে লোকজন স্কি করছে, ছেলে-বুড়ো পুরো ফ্যামিলিশুদ্ধ। স্কি করতে দেখাটা বেশ অ্যাডিক্টিভ, বাস থেকে সবাইকে দেখে বেশ লোভ হচ্ছিলো। সাথের রাশিয়ান একজন বললো, দেখতে যত সোজা বাস্তবে তার চাইতে ঢের কঠিন, তবে বিগিনারদের জন্যে আলাদা ট্র্যাকও আছে। যাহোক আমরা বাসে করে যতটুকু যাওয়া যায় গিয়ে সেখান থেকে ১০ ইউরো দিয়ে কেবল কারের টিকিট কাটলাম। কেবল কার জিনিসটাই আমার ব্যাপক প্রিয়, আর ওইরকম পাহাড় আর বরফের উপর দিয়ে গেলে তো সোনায় সোহাগা! উপরে গিয়ে আমরা যারপরনাই মুগ্ধ আর একই সাথে ঠাণ্ডায় জমে বরফ। আমরা ছিলাম ২৯৫০ মিটার উপরে। ঝকঝকে রোদেলা দিনে সবাই মিলে যার যা আছে ঝাঁপিয়ে পড় নীতিতে যার যার ক্যামের নিয়ে ছবি তুলতে লেগে গেলো। আমরা যে রাস্তা ধরে আসলাম, সেই রাস্তাটা দেখা যাচ্ছিলো উপর থেকে।



কে শোনে কার কথা! অনেক দুঃসাহসীদের দেখা গেলো কেবল কারে করে উপরে এসে ধুমধাম স্কি করতে নেমে যাচ্ছে। এমনই এক দলের সাথে ছবি তোলা হলো।
ঠাণ্ডায় হাত জমে যাচ্ছিলো বলে অনেকেই একটু পর পর বাথরুমের হ্যান্ড ড্রায়ারে হাত 'গরম' করে নিচ্ছিলো। বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া খিচুড়ি-গরুর মাংস দিয়ে লাঞ্চ সারা হলো। তারপর উপরের রেস্টুরেন্টের আরামদায়ক উষ্ণতায় এক কাপ গরম চকোলেট উইথ হুইপড ক্রিম!
উপরে প্রায় দুঘন্টা কাটিয়ে কেবল কারে করে নেমে এলাম। তারপর ঘরে ফেরার পথে একটা লেকের (Lake Carezza) পাশে থামা হলো, শুনেছিলাম খুব সুন্দর এই লেকের পানি নাকি পুরো সবুজ। আমরা অবশ্য সাদা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না - পুরো লেকটাই জমে ছিলো!
এটা লেকের পাড় থেকে তোলা ছবি, বামদিকের গাছের ফাঁকে যা দেখা যাচ্ছে ওইটাই লেক। চারপাশে এত পুরু হয়ে বরফ জমে ছিলো যে ছবিও তোলা যায়নি ঠিকমত।
পুরো ট্যুরের ছবির ফেসবুক অ্যালবামঃ
প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব